একজন আদর্শ রমনি
(কষ্ট হলেও সম্পূর্ণ পোস্ট পড়ার অনুরোধ রইলো)
#একজন_আদর্শ_রমণী
রাজিয়া’র কথা।
শান্ত ও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের মেয়ে রাজিয়া। যেমন
সুন্দরী তেমন দীনদারও বটে। আজ তাঁর বিয়ে।
কাবিন লেখার জন্য কাজী সাহেব উপস্থিত । বর ও
কনে পক্ষের মুরুব্বীরাও সেখানে আছেন।
এক পর্যায়ে কাজী সাহেব কনের বাবাকে
জিজ্ঞেস করলেন, মোহরানা কত টাকা ঠিক
করেছেন আপনারা?
কনের বাবা নিয়াজ আহমদ কিছু বলার সুযোগ
পেলেন না। তাঁর আগেই তাঁর বড় জামাই শরীফ
উদ্দীন বরের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
আমরা তিন লক্ষ টাকা ঠিক করেছি। আপনি কী
বলেন?
টাকার অঙ্ক শুনে বরপক্ষ যেমন অবাক হলেন,
তেমনি রেগেও গেলান। বরের বাবা ইলিয়াস মির্জা
অনেক কষ্টে রাগ সামলে বললেন, মোহরানা
এমন রাখা উচিত যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা
সম্ভব। কারন স্বামী যদি মোহরানা আদায় না করে মারা
যায়, তবে হাশরের মাঠে যেনাকারিদের দল্ভুক্ত
হয়ে উঠবে।
এসময় বরপক্ষের আরেক মুরুব্বী বললেন, হ্যাঁ,
মোহরানা ব্যাপারে আমরাও তা-ই জানি। সেদিন এক
হুজুরের মুখে আরো শুনেছি যে, মোহর নাকি
বিয়ের আসরে অথবা বাসর ঘরে আদায় করাই
উত্তম। অবশ্য স্ত্রী ইচ্ছে করলে আংশিক
মোহর কমিয়ে দিতে পারে কিংবা পুর মোহরও মাফ
করে দিতে পারে। এটা এক্মাত্র স্ত্রীর
ইচ্ছাধীন ব্যাপার। কিন্তু স্বামী যদি টাকা না দেওয়ার
মতলবে স্ত্রীকে ভালোবাসার গাল-গল্প শুনিয়ে
অথবা কোনো কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মাফ
করিয়ে নেয়, তাহলে তা মাফ হবে না। কিছুক্ষণ
আগে আমাদের বর-মামুন আমাকে বলে গেছে
যে, সে নাকি প্রথম রাতেই মোহরানার পূর্ণ টাকা
আদায় করে দিবে। সে আরো বলেছে যে,
উক্ত টাকার পরিমাণ যেন দুই লক্ষ টাকার মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকে। এর চেয়ে বেশি মোহর আদায়
করার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই। তাই আমি দুই লক্ষ
টাকা মোহর নির্ধারণ করার অনুরোধ করছি।
মেয়ের বাবা বললেন, আপনার কথা আমরা মেনে
নিলাম।
বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর বরপক্ষের একজন
কনের বাবাকে বললেন, জামাইওকে ঘরে নিয়ে
তাঁর হাতে আংটি পরিয়ে মেয়েকে সঁপে দিবেন
না?
নিয়াজ আহমদ বরপক্ষের লোকটিকে সম্বোধন
করে বললেন, ভাই! আমরা মুসলমান। ইসলাম
আমাদের ধর্ম। তাই বিয়ে শাদী থেকে শুরু করে
সকল কাজকর্মে আমাদের উচিত ইসলামের বিধি-বিধান
অনুসরণ করা। নবী করীম (সাঃ) এর সুন্নতের প্রতি
দৃষ্টি রাখা। কেননা এর মধ্যেই আমাদের শান্তি ও
সফলকাম নিহিত আছে। আপনি যে এখন জামাইকে
আংটি পরিয়ে মেয়েকে তাঁর কাছে সঁপে দিতে
বললেন এটা আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি
কুপ্রথা। ইসলামে এর কোনো দলিল নেই।
তদুপরি পুরুষদের জন্যে সোনার অলঙ্কার পরিধান
করা পরিস্কার হারাম।
এসব কথা আমি অসংখ্যবার হযরত উলামায়ে কেরামের
মুখে শুনেছি।
বরের পিতা ইলিয়াস মির্জার বাড়ী গ্রাম এলাকায়।
সেখানে গাড়ি কিংবা রিক্সা চলার মতো রাস্তা এখনো
হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে বাস্টস্ট্যান্ড থেকে বর ও
কনেকে পালকিতে করে আনতে হয়েছে।
এখানকার প্রথা হলো, বরের বড় দুলাভাই নববধূকে
পাজাঁকোলে করে পালকি থেকে উঠিয়ে নিয়ে
যাবেন। বড় দুলাভাই খুব মোটাসোটা। তাই তিনি ছোট
ভাইরা ভাই আসিফকে বললেন, ভাই! তুমি আমার হয়ে
কাজটা করে দাও।
কনে রাজিয়া পালকির ভিতর থেকে একথা শুনে
লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। আসিফ যখন পালকির দরজা
খুলে রাজিয়াকে কোলে নিতে গেল তখন রাজিয়া
পালকির একোণে সরে গিয়ে বলল, আপনি দয়া
করে একটু দূরে সরে দাড়ান। আমাকে কোলে
নিতে হবে না। আমি নিজেই হেঁটে ঘরে চলে
যেতে পারব। আর হ্যাঁ, আপনাদের জানা উচিত যে,
গায়রে মাহরাম বালেগ ছেলে-মেয়ে একে
অপরকে স্পর্শ করাও হারাম।
নতুন বউয়ের মুখে এসব কথা শুনে শুধু আসিফ
কেন উপস্থিত সকলেই খুব অবাক হলো। কিন্তু
কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
বরের ছোট বোন গালিবা। সমাজে প্রচলিত নতুন
বয় তোলার এ প্রথাটি যে নাজায়েজ তা সে কিতাবে
পড়েছে। একথা সবাইকে সে আগে
বলেছেও। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ কান দেয়নি।
এবার রাজিয়ার কথা শুনে সে খুব খুশি হলো। পর্দার
সাথে এগিয়ে এসে ভাবীর একটা হাত ধরে বলল,
ভাবী! আমি গালিবা। আপনার ছোট ননদ। ঘরে চলুন।
এ বলে সে রাজিয়াকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল।
এ দৃশ্য দেখে দু’একজন বয়স্ক মহিলা রেগে
গিয়ে বললেন, এ কেমন মেয়েরা বাবা! বিয়ের
কনে হয়ে সবার সামনে নতুন বউ হয়ে কথা
বলতে লজ্জা করল না?
তাদের কথা শুনে গালিবা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু
রাজিয়া নিষেধ করে বলল, এরা অশিক্ষিত মহিলা।
এদেরকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে পথে আনার
চেষ্টা করতে হবে। এখন এদের মুখের উপর
কথা বললে আরো বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তাই এখন চুপ থাকাই শ্রেয়।
মামুনের মা জাহেদা বেগমও নতুন বউ- এর কথায়
অসন্তুষ্ট হন। তাই স্বামীকে উদ্দেশ্য করে
বলেন, দেখলেন তো নতুন বউওয়ের ব্যবহার!
আমি আগেই তো বলেছিলাম, মোল্লা বাড়ির
মেয়ে এনো না। ওরা সমাজের কোনো প্রথাই
মেনে চলবে না।
পালকি থেকে ঘরে যাওয়ার ব্যাপারে রাজিয়া যেসব
কথা বলেছে তা শুনে ইলিয়াস মির্জা মনে মনে
বেশ খুশি হয়েছেন। খুশি হয়েছেন তাঁর মেয়ে
গালিবার আচরণেও। তাই স্বীয় স্ত্রীকে নতুন বউ
ও তাঁর বাপের বাড়ী সম্পর্কে অভিযোগ করতে
শুনে বললেন, তুমি রাগ করছ কেন? বউমা তো ঠিক
কথাই বলেছে। কুরআন হাদিসের কথাই বলেছে।
সুতরাং তাঁর পক্ষে কি ন্সমাজে প্রচলিত ইসলাম
বিরোধী খারাপ রীতি –নীতি মেনে নেওয়া
সম্ভব? যা হোক, এখন শান্ত হও। লোকজনের
সামনে এ নিয়ে হৈ চৈ করো না।
স্বামীর কথা শুনে জাহেদা বেগম রাগে গড়গড়
করতে করতে সেখান থেকে চলে গেলেন ।
আজ মামুন ও রাজিয়ার বাসর রাত । মামুন দরজা জানালা বন্ধ
করে খাটের উপর এসে বসল। রাজিয়া তাঁর
প্রিয়তমকে সালাম দিল। সালামের উত্তর দিয়ে রাজিয়ার
মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে দেখল, রাজিয়া চোখ
বন্ধ করে আছে।
মামুন বলল, চোখ বন্ধ কেন? আমাকে পছন্দ
হয়নি? পছন্দ না হওয়ারই কথা ! কারন আমি তো
তোমার মতো সুন্দর নই !!
রাজিয়া চোখ খুলে বলল, আপনি শুধু সুন্দর নন,
অসম্ভব সুন্দর!!
নিশ্চয় তুমি আমার মন রক্ষা করার জন্য এসব বলছ।
আসলে আমিতো কালো-ই।
সব মানুষের কাছে আপনি কালো হলেও আমার
নিকট সুন্দর ও সুপুরুষ।
এখন এসব কথা রেখে আসুন দু;রাকাত নফল নামায
পড়ি এবং আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করি।
বাসর রাতে আল্লাহ-বিল্লাহ করার কথা শুনে মামুন কিছুটা
অসন্তুষ্টই হলো। তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল
নাখোশ ভাব।
রাজিয়া স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে
বলল, প্রিয়তম! আমার কথায় আপনি মনে কোনো
কষ্ট নিবেন না। আসলে আমরা নতুন এক জীবন
শুরু করছি তো! তাই শুরুতেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ
রাব্বুল আলামিনের নাম স্মরণ করে তাঁর প্রতি
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চেয়েছিলাম। কেননা
তিনি যদি আমাদের প্রতি অনুগ্রহের বাড়ী বর্ষণ না
করতেন তাহলে আপনি আমি কখনোই একত্রিত
হতে পারতাম না। তাই আবারো বলছি, আপনি
কোনো কষ্ট নিবেন না। যদি আমার কথায় আপনি
অসন্তুষ্ট কিংবা বিরক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে মাফ
চাইছি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন।
রাজিয়ার সুন্দর কথা ও তাঁর কোমল ব্যবহারে মামুন খুব
খুশি হলো। সে বলল-না, এতে অসন্তুষ্ট বা নারাজ
হওয়ার কী আছে? তুমি একটু অপেক্ষা করো,
আমি অযু করে আসি। এ বলে সে ঘর থেকে
বের হয়ে গেল। মামুন অযু করে ফিরে এসে দেখল, রাজিয়া তাঁর হাত-
মুখের পানি মুছে দেওয়ার জন্য গামছা নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। সেই সাথে সে এও দেখল যে,
রাজিয়া আগেই তাঁর জন্য নামাজের মুসল্লা বিছিয়ে
রেখেছে।
হাত, মুখ ও পা পরম মমতায় মুছে দেওয়ার মামুন বেশ
পুলকিত হলো। মনে মনে বলল, শুনেছিলাম
মাদ্রাসার পড়ুয়া মেয়েরা নাকি স্বামীর খেদমত
করে না। কই! একথা তো ঠিক নয়। রাজিয়া তো
দেখছি আমাদের মধ্যে ভালোভাবে পরিচয় হওয়ার
আগেই আমার খেদমত শুরু করে দিয়েছে এবং
আমার মন খুশি করার জন্য চেষ্টা করে চলেছে।
এ সময় তাঁর মনে চাচ্ছিল, রাজিয়াকে একটু আদর
করে তাঁর খেদমতের প্রতিদান দিতে! কিন্তু সে
সুযোগ পাওয়া গেল না। কেননা ততক্ষণে নাজিয়া
নামাজের মুসল্লার দিকে ইশারা করে বলতে শুরু
করেছে, আপনি এখানে নামাজ পড়ুন।
নামাজ ও দোয়া শেষ করে তারা আনন্দের এক
নতুন জগতে প্রবেশ করল এবং রাতের শেষ
প্রহর পর্যন্ত এভাবেই কাটাল।
শেষ রাতে রাজিয়া স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি
নিয়ে পবিত্রতা অর্জন করল এবং তাহাজ্জুদ নামাজ
আদায় করে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে স্বামীর
হেদায়েত চেয়ে খুব কান্নাকাটি করল। এদিকে
মামুন সারারাত নির্ঘুম থাকায় কখন যে ঘুমিয়ে গেছে
বলতে পারল না। তাই সে রাজিয়ার নামাজ কিংবা কান্নাকাটি
কোনোটাই দেখল না।
ফজরের আজানের পর রাজিয়া তাঁর স্বামীকে
লক্ষ্য করে বড়ই মমতা ভরা কন্ঠে বলল, এখন আমি
আপনার কাছে একটি অনূরোধ রাখব। আপনি কি আমার
সেই অনুরোধটি রক্ষা করবেন?
মাদরাসা পড়ুয়া রাজিয়াকে আনস্মার্ট ভেবে প্রথমে
বিয়ে করতে চায়নি মামুন। কিন্তু আমার কাছে তাঁর
অপরিসমীম রূপ সৌন্দর্যের কথা শুনে বলেছিল,
মেয়ে দেখে মতামত জানাবে। তারপর রাজিয়াকে
দেখতে গিয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। সেদিন যতটা
না মুগ্ধ হয়েছিল আজ বাসর রাতে তাঁর আচার-
আচরণে আরো মুগ্ধ হয়েছে সে। এখন তাঁর
অনুরোধের কথা শুনে বলল, বলেই দেখো না,
রাখি কি না!
এভাবে বললে হবে না, ওয়াদা করতে হবে!
না শুনে ওয়াদা করব কীভাবে? যদি এমন কিছু হয় যা
পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তখন আমার ওয়াদা
কী হবে!!
না, আমি আপনাকে এমন কিছু বলব না, যা পালন করতে
আপনি অক্ষম। তদুপরি আমার কথাটি রক্ষা করতে
আপনার কোনো টাকা পয়সাও খরচ হবে না।
ঠিক আছে ওয়াদা করলাম। এবার বলো তুমি কি বলতে
চাও।
আমার অনুরোধ হলো, আজ থেকে নিয়মিত পাঁচ
ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন। কোনোভাবেই নামাজ
ছাড়তে পাড়বেন না।
মৃদু হেসে মামুন বলল, যদি না পড়ি?
মনে খুব কষ্ট পাব। তাছাড়া ওয়াদা ভঙ্গের জন্য
আপনার গুনাহ হবে।
আপনাকে গুনাহগার করার জন্য আমিও
পরোক্ষভাবে দায়ি থাকব, সেজন্য মনে খুব ব্যথা
অনুভব করব।
এতে আবার মনে কষ্ট পাওয়ার কি আছে? ধর্ম
তো একটা ব্যক্তিগত বিষয়। যার ইচ্ছা হয় মানবে,
ইচ্ছা না হলে মানবে না। তাছাড়া শুনেছি, ধর্মের
কাজে জোর জবরদস্তি নেই।
আমি তো আপনাকে জবরদস্তি করছি না, অনুরোধ
করছি। আর ধর্মে জোর জবরদস্তি না থাকলেও
ধর্মীয় বিধি থাকলেও নিধি নিষেধ মেনে চলা
প্রত্যেক মুসলমান নর০নারীর অবশ্য কর্তব্য।
নচেৎ সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে না।
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেন, হে বিশ্বাসী
বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয়
করো এবং প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো
না। তিনি অন্যত্র বলেছেন, হে বিশ্বাসী বান্দাগণ,
তোমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণ রূপে প্রবেশ
করো। এখন আপনিই বলুন, এসব কথা জানার পরও কি
কোনো ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে
পারে?
স্ত্রীর কথা শুনে মামুন বুঝতে পারল, শয়তান
তাঁকে এতদিন ধর্মের পথ থেকে ফিরিয়ে
রেখেছে। তাই সে রাজিয়ার কথা শেষ হতেই
বলল- না, কোন মানুষেরই আল্লাহর বিধান অমান্য করা
উচিত নয়। আমি তোমার সাথে ওয়াদা দিলাম, আজ
থেকে আর কোনোদিন নামায কাযা করব না।
স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাজিয়া
আলহামদুলিল্লাহ্ বলে আল্লাহর শোকর আদায়
করল। তারপর বলল, তা হলে দেরী নয়। এখনই
পবিত্রতা অর্জন করে ফজরের নামায পড়ার জন্য
মসজিদে চলে যান। মামুন তাই করল।
মামুনকে ফজর নামাজের জামাতে দেখে ইলিয়াস
মির্জা চোখের পানি ফেলে আল্লাহর শুকরিয়া
আদায় করলেন। মনে মনে বললেন, যে কাজ
আমি দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও পারিনি, আমার বউমা
একদিনেই তা পেরে ফেলেছে।
আলহামদুলিল্লাহ্ ! তারপর দু’হাত উঠালেন। বললেন,
হে আল্লাহ! যে উদ্দেশ্যে মা রাজিয়া কে
পুত্রবধূ করে এনেছি তা তুমি পূর্ণরূপে পূরণ করিও।
সকালে গালিবা বলল, ভাবী! এখানকার সমাজের রীতি
হলো, ওলিমার দিন আত্মীয় – স্বজন ও পাড়ার
মুরুব্বীরা টাকা দিয়ে নতুন বউয়ের মুখ দেখে।
রাজিয়া বলল, যারা আমাকে দেখবে তাদের সবাই যদি
নারী হন তবে তো কোনো সমস্যা নেই।
তবে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা ঠিক নয়। আর
দর্শনার্থীরা যদি নারী না হয়ে পুরুষ হন তবে
কোনোভাবেই এই নিয়মকে শরীয়ত সমর্থন
করবে না। কেননা শরীয়তের পর্দা করা ফরয।
কোনো নারীকে মাত্র চৌদ্দজন মাহরাম পুরুষ ছাড়া
অন্য কোনো পুরুষ দেখতে পারে না। নববধূর
বেলায়ও ঐ একই কথা প্রযোজ্য। তাকেও মাহরাম
পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ দেখতে পারবে
না। যদি কেউ শরীয়তের এই নিয়মকে অমান্য
করতঃ নিজকে অন্যের সামনে প্রদর্শন করে বা
অন্যারা তাঁকে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করে এবং সে
তাতে রাজী থাকে তবে সবাই মহাপাপী বলে
সাব্যস্ত হবে। তাই আমি তোমাকে পরিস্কার জানিয়ে
রাখছি, এই কুপ্রথা আমি কিছুতেই মানব না এবং কাউকে
মানতেও দিব না।
ওলীমার দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আত্মীয় –
স্বজন ও মুরুব্বীরা যখন নতুন বউ দেখার জন্য
বারান্দায় এসে ভীড় জমাল তখন গালিবা দরজায় আড়াল
থেকে তাদেরকে সম্বোধন করে বলল,
আপনারা যে উদ্দেশ্যে এসেছেন, সে
ব্যাপারে ভাবী বলেছেন, আপনাদের মধ্য
কেবল নারীরাই তাঁকে দেখতে পারবেন। পুরুষরা
নয়। কারণ যে চৌদ্দজনের সঙ্গে বিয়ে চিরতরে
হারাম তারা ছাড়া অন্য পুরুষ কোনো মেয়েকে
দেখতে পারে না। এটা ইসলামের বিধান। তাই ভাবী
আপনাদের কাছে আশা করেছেন, শরীয়তের
এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে সমাজে বাস্তাবায়নের
ব্যাপারে আপনারা তাঁকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা
করবেন।
সমবেত লোকদের মাঝে গালিবার মা সাহেদা
বেগমও ছিলেন। গালিবার কথা শেষ হতে না হতেই
তিনি রাগতঃ কণ্ঠে বলে উঠলেন, বাপরে বাপ!
এরকম কথা আমাদের চৌদ্দ পুরুষও শুনেনি। মুরুব্বী
লোকেরা বাপ-দাদার মত। তারা নতুন বউয়ের মুখ
দেখলে এমন কি দোষ হয়ে যায় তা আমার মাথায়
ঢুকছে না। আর দেবর, ভাসুর, নন্দাই তারা তো
ঘরেরই লোক! তারা নববধূর মুখ দেখলে
বউয়ের কিংবা তাঁর ধর্মের এমন কি ক্ষতি হয়ে যাবে
তাও আমার বোধ গম্য নয়!!
এমন সময় সবাই চলে যেতে দেখে জাহিদা
বেগম খুব রেগে গিয়ে নতুন বউকে উদ্দেশ্য
করে বড় গলায় বললেন, ওহে আমার সাধের
পুত্রবধূ! তুমি তো আজ মির্জা বাড়ির ইজ্জত ধূলোয়
মিশিয়ে দিলে। আমি অবশ্যই তোমার বাপের কাছে
এর বিচার চাইব!
কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর গালিবা ছোট
ভাবীকে বলল, ভাবি! আমাদের বাড়ীতে আসার
পর আপনাকে তো দেখছি, সবকিছুতেই সফল!
এবার এক কাজ করুণ। আমাদের বাসায় টিভি দেখা বন্ধ
করা নিয়ে কী করা যায় এ নিয়ে একটু ভাবুন!
রাজিয়া বলল, এখানে আসার পর থেকেই এ নিয়ে
আমি ভাবছি। তবে ঠিক কিভাবে এগুবো, চিন্তা করে
ঠিক করতে পারছি না। তুমি তো জানো যে, আম্মা
এবং বড় তিন জাল আমার উপর এজন্য অসন্তুষ্ট যে,
আমি টিভি দেখতে যাই না। এদিকে সরাসরি তোমার
ছোট ভাইয়াকে যদি টিভি দেখতে নিষেধ করি
তাহলে তিনিও আমার উপর নাখোশ হবেন। আমার
ধারণা, আমি যদি তোমার ভাইয়াকে টিভি দেখতে
নিষেধ করি, তাহলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি
দেখবেন না ঠিক, কিন্তু আমার প্রতি মনে মনে
যেমন রুষ্ট হবেন শান্তিও পাবেন না। আর যদি বাসার
সবাইকে টিভি দেখার উপকারিতা ও অপকারিতা বুঝিয়ে
বলার পর নিষেধ করি, তাহলে আমার উদ্দেশ্য
যেমন পুরোপুরি সফল হবে, তেমনি মনে মনে
তিনি শান্তিও পাবেন। তাই ভেবেছি প্রতি শুক্রুবার
সবাইকে নিয়ে তালীম করব এবং তালীমের
মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে টিভি দেখার লা-ক্ষতি সহ
আরো অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা
রাখব।
খানিক পর গালিবার কাছ থেকে রাজিয়ার পরিকল্পনার কথা
শুনে ইলিয়াস মির্জা সীমাহীন খুশি হলেন। তাই তিনি
রাজিয়াকে ডেকে বললেন, তোমার পরিকল্পনার
কথা শুনে খুব খুশি হলাম মা। তাই তুমি দেরী না করে
আগামী শুক্রুবার থেকেই তালীম শুরু করে দাও।
শ্বশুরের সম্মতি পেয়ে পরবর্তী শুক্রুবার
থেকেই রাজিয়া ফাযায়েলের তালিম শুরু করে দিল।
প্রথম প্রথম জাহেদা বেগম তালীমে বস্তেন না।
কিন্তু খোদার ফযলে রাজিয়ার সদাচরণ ও খেদমতে
মুগ্ধ হয়ে তিনিও তালীম বসা শুরু করলেন।
রাজিয়া তালীমের শুরুতে ফাযায়েলে আমল নামক
কিতাব থেকে পড়ে পড়ে শুনাত এবং শেষ দিকে
অতি প্রয়োজনীয় কিছু কথা ও মাসআলা মাসায়েল
আলোচনা করত। একদিন পূর্ব পরিকল্পপনা অনুযায়ী
গালিবা জিজ্ঞেস করল, ভাবী! আজকে
আমাদেরকে টিভি দেখার লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে কিছু
বলবেন কি?
রাজিয়া বলল, হ্যাঁ, তুমি যখন বলছ তাহলে বলি। এ বলে
সে এ বিষয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট কথা বলল। টিভি দেখার
ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে পয়েন্ট ভিত্তিক
জোড়ালো আলোচনা রাখল। তাঁর এই আলোচনা
এতই ফলপ্রসূ হলো যে, জাহেদা বেগম নিজেই
বলতে লাগলেন, টিভি দেখার ক্ষতি যে
এওতবেশী ও এত মারাত্মক তা আমি কোনোদিন
শুনিনি। আমি যদি এসব শুরুত্বপূর্ণ কথা আগে শুনতাম
তবে কবেই দোযখের এই বাক্সটাকে
ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতাম! যাক তবু আল্লাহর
শোকর যে, আমাদের বউমার ওসিলায় অনেক
দেরীতে হলেও আমরা এ সম্পর্কে জানতে
পেরেছি। তাই আমি এখনই তোমাদের সামনে
ঘোষণা করছি, আজ থেকে আর কোনোদিন
এই বাড়ীতে টিভি চলবে না।
স্ত্রীর কথা শুনে ইলিয়াস মির্জা মুচকি হাসলেন।
কৌতুক করে বললেন, ওটাকে ঘর থেকে বের
করার জন্য তো তোমাকে কত বলছি! কিন্তু আমার
কথায় একবারও কান দাওনি। আজ দেখছি বউমার কথায়
বেশ কাবু হয়ে গেলে!
জাহিদা বেগম বললেন, কাবু হবো না তো কি
হবো! এমন সুন্দর করে আপনি কি আমাকে বলতে
পেরেছেন?
থাক বাবা, কথ বাড়িয়ে লাভ নেই। এখন বলো, কখন
ওটাকে ডাস্টবিনে ফেলছ?
কখন আবার কি? এই দেখো এখনই আমি যাচ্ছি। এই
বলে তিনি গালিবাকে নিয়ে টিভি রুমে গেলেন এবং
হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে টিভির বারটা বাজিয়ে ছাড়লেন!
তারপর গালিবাকে বললেন ওগুলো নিয়ে
ডাস্টবিনে ফেলে এসো।
গালিবা খুশিমনে মায়ের নির্দেশ পালন করল। সেই
সাথে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তাবায়ন হতে দেখে
যারপরনাই খুশি হলো।
সেদিনের তালিমে মামুন ছিল না। রাতে বাসায় ফিরে
মায়ের মুখ থেকে পুরো কাহিনী শুনল। যখন তাঁর
মা বলল, আমিই নিজ হাতে ওটাকে ভেঙ্গেছি তখন
সে আর কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না।
এভাবে রাজিয়ার তালীমের ওসিলায় মামুনদের বাসা
থেকে টিভি নিশ্চিহ্ন পূর্ণ দীনদার কায়েম হয়। বাড়ির
সবাই এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। মহিলারা পর্দা করে
চলাফেরা করে। এছাড়া শরীয়তের অন্যান্য বিধান
পালনের ব্যাপারেও দারুণ আগ্রহী।
উল্লেখ্য যে, রাজিয়ার অব্যাহত প্রচেষ্ঠায় গত
কয়েকদিন পুরবেমামুন এক চিল্লায় জন্য তাবলীগ
জামাতে বের হয়ে গেছে। মামুন রাজিয়াকে
ফোনে বলেছে, রাজিয়া! ঘর থেকে টিভি বের
করার কারণে আমি তোমার উপর সামান্য নাখোশ
হয়েছিলাম সত্য, কিন্তু আজ মাই বুঝতে পারছি যে,
তুমি আমাদের পরিবারের উপর কতবড় অনুগ্রহ
করেছ। তাছাড়া আমার উপর তোমার সবচেয়ে বড়
অনুগ্রহ এই যে, তুমি আমাকে আল্লাহর রাস্তাহ্য
পাঠিয়েছ। এখানে এসে আমি আজ বুঝতে
পেরেছি, জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
বুঝতে পেরেছি, নবীজির সুন্নতের উপর আমল
করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। তুমি যদি আমাকে
জোর করে তাবলীগে না পাঠাতে তাহলে জানি না
পরকালে আমার থিকানা কোথ্য হতো! আর হ্যাঁ, তুমি
শুনে নিশ্চয় খুশি হবে যে, আমি দাড়ি রেখেছি। এবং
এই প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আর কোনোদিন
দাড়িতে হাত দিব না। কেননা আমি জানতে পেরেছি
যে, দাড়ি মুণ্ডন করা কিংবা কাটছাট করে এক মুষ্ঠির
চেয়ে কমিয়ে ফেলা হারাম ও নাজায়িজ। তাছাড়া এই
গোনাহ নাকি এমনই এক মারাত্মক গোনাহ যা
সর্বাবস্থায় লিখা হতেই থাকে। এমনকি ঘুম কিংবা
নামাজরত অবস্থায়ও। আর হ্যাঁ, আরেকটি কথা-
দেখো, চিল্লা থেকে ফিরে আসার পর আপন
প্রিয়তমকে দাড়ির কারণে চিনতে ভুল করো না
যেন!!
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! বিয়ে হল সংসার জীবনে সাথী
নির্বাচন। এই সাথী নির্বাচন খুব হুশিয়ারের সঙ্গে
কথা একান্ত কর্তব্য। যারা এই নির্বাচনে ভুল করে
তারা যেমন সারা জীবন অনুশোচনার আগুনে
জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়, তেমনি দুনিয়াতেই ভোগ
করে জাহান্নামের শাস্তি। দোয়া করি, আল্লাহ পাক
প্রতিটি নারীকে রাজিয়ার মতো দীনদার ও
পরহেযগার বানিয়ে দিক এবং প্রতিটি পুরুষকে তাঁর
মতো দীনদার ও গুণোধর স্ত্রী দান করুক।
আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামিন।-
আদর্শ স্বামী ২ বই

Comments
Post a Comment